ময়নামতি কুমিল্লায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থান। যা রানী ময়নামতির নামানুসারে নামকরন হয়। ময়নামতির পূর্ব নাম রোহিতগিরি। সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে শালবন বিহার, পাহারপুর বুদ্ধবিহার, লালমাই পাহাড়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সরণি, বিশ্বযুদ্ধ সমাধি সহ রূপবান মুড়া, ইটাখুলা মুড়া, রানী ময়নামতির প্রাসাদ রয়েছে।
শালবন বিহারের পাশেই ময়নামতি জাদুঘর রয়েছে। ১৯৬৫ সালে কুমিল্লা কোটবাড়ীর শালবন বিহারের দক্ষিণ পাশে শালবনকে সামনে রেখে পশ্চিমমুখী একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়। এ স্থানটি দর্শনে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটে। ঢাকা থেকে ১১৪ কি.মি. দূরে ময়নামতির অবস্থান এবং চট্টগ্রাম থেকে মাত্র আড়াই ঘন্টায় ময়নামতি পৌঁছানো সম্ভব।
১. শালবন বিহার (Shalban Vihara)

ময়নামতির সবচেয়ে বিখ্যাত ও বড় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
এটি একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার (মঠ), যা ৮ম শতকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন। শালবন বিহারের প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ। বিহারের চার দিকের দেয়াল পাঁচ মিটার পুরু। কক্ষগুলো বিহারের চার দিকের বেষ্টনী দেয়াল পিঠ করে নির্মিত। বিহারে ঢোকা বা বের হওয়ার মাত্র একটাই পথ ছিল। প্রতিটি কক্ষের মাঝে ১.৫ মিটার চওড়া দেয়াল রয়েছে।
এখানে প্রায় ১১৫টি কক্ষ রয়েছে যেগুলো মূলত ভিক্ষুদের থাকার জন্য ব্যবহৃত হতো।
কেন্দ্রে রয়েছে একটি মূল স্তূপ বা মন্দির।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিহারটির ধ্বংসাবশেষ থেকে আটটি তাম্রলিপি, প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা, সিলমোহর, ব্রৌঞ্জ ও মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে। এগুলো বাংলাদেশের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করছে।
বিহারের বাইরে প্রবেশ দ্বারের পাশে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি হলঘর রয়েছে। চার দিকের দেয়াল ও সামনে চারটি বিশাল গোলাকার স্তম্ভের ওপর নির্মিত সে হলঘরটি ভিক্ষুদের খাবার ঘর ছিল বলে ধারণা করা হয়। হলঘরের মাপ ১০ মিটার গুণন ২০ মিটার। হলঘরের চার দিকে ইটের চওড়া রাস্তা রয়েছে।
২. ময়নামতি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর

এখানে শালবন বিহার ও আশপাশের খননকৃত স্থান থেকে উদ্ধার করা বহু মূল্যবান নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে।
জাদুঘরে রয়েছে ৭ম শতকে তৈরি বেলে পাথরে দণ্ডায়মান বৌদ্ধের মূর্তি।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দ্রব্যের মধ্যে ব্রোঞ্জের বিশাল ঘণ্টা, (ওজন ৩৭০ কেজি) কালো পাথরের শিবের বাহন,বিভিন্ন ধরনের পাথরের দণ্ডায়মান লোকোত্তর বুদ্ধমূর্তি, ত্রি-বিক্রম বিষ্ণুমূর্তি, তারা মূর্তি, মারীছী মূর্তি, মঞ্জুরের মূর্তি, পার্বতী মূর্তি, হরগৌরী মূর্তি, নন্দী মূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি, মনসা মূর্তি, গণেশ মূর্তি, সূর্যমূর্তি, হেরুক মূর্তি এবং ব্রোঞ্জের বজ্রসস্ত মূর্তি।
৩. কোটিলা মুরা
.jpeg)
এটি একটি বৌদ্ধ স্তূপ ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
এখানে তিনটি স্তূপ একসঙ্গে অবস্থিত, যা বৌদ্ধ ত্রিস্মৃতি (ত্রিরত্ন) প্রতিনিধিত্ব করে।
৪. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সরণি ও বিশ্বযুদ্ধ সমাধি

- ময়নামতি রণ সমাধিক্ষেত্র মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) নিহত ভারতীয় (তৎকালীন) ও ব্রিটিশ সৈন্যদের কবরস্থান। এটি ১৯৪৩-১৯৪৪ সালে তৈরি হয়েছে।
- ময়নামতি তখনকার সময়ে একটি ক্ষুদ্র গ্রাম হলেও তৎকালীন সেনাবাহিনীর একটি বড় ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এখানে স্থাপিত হয় বড় একটি হাসপাতাল। এছাড়া কুমিল্লা ছিল যুদ্ধ-সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্র, বিমান ঘাঁটি।
- যুদ্ধের পর বিভিন্ন স্থান থেকে কিছু লাশ স্থানান্তর করেও এখানে সমাহিত করা হয়। বাহিনী অনুযায়ী এখানে এর মধ্যে রয়েছেন ৩জন নাবিক, ৫৬৭জন সৈনিক এবং ১৬৬জন বৈমানিক সহ সর্বমোট ৭২৩ জন নিহতের পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছিল। যাদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৩৫৭ জন।
৫. চণ্ডিমুরা (Chandimura)
পাহাড়ের উপরে অবস্থিত একটি হিন্দু মন্দির।
এখান থেকে আশপাশের দৃশ্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।
ময়নামতির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি
১. শালবন ও পাহাড়ি বনাঞ্চল
ময়নামতির আশেপাশে ছড়িয়ে আছে শালগাছের বন, যা একটি শান্তিপূর্ণ এবং মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে।
পাখির ডাক, বাতাসে পাতার শব্দ প্রকৃতি প্রেমীদের আকর্ষণ করে।
২. ছোট পাহাড় ও টিলার সমাহার
এই এলাকা পাহাড়ি টিলা ও ঢালু ভূপ্রকৃতির কারণে প্রাকৃতিক দৃশ্যপট বেশ আকর্ষণীয়।
এগুলোতে উঠে গেলে চারপাশের কুমিল্লার অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়।
৩. সবুজ মাঠ ও কৃষিক্ষেত্র
শালবন বিহারের চারপাশে রয়েছে বিস্তৃত সবুজ মাঠ ও ধানক্ষেত, যা মনকে প্রশান্ত করে।
ভ্রমণের টিপস:
ঢাকা থেকে কুমিল্লা মাত্র ২–৩ ঘণ্টার পথ (বাস বা ট্রেনে সহজে যাওয়া যায়)।
ঐতিহাসিক স্থান ঘুরতে চাইলে গাইড নিলে ভালো হয়।
শীতকালে ঘুরতে যাওয়ার সময় সবচেয়ে উপযুক্ত।
ময়নামতির অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানসমূহ
৫. ইটাখোলা মুরা
এটি একটি বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
খননের ফলে এখানে একটি বড় আকারের বৌদ্ধ চৈত্য এবং বহু টেরাকোটা পাওয়া গেছে।
৬. রূপবান মুরা
পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত একটি পুরাতন বৌদ্ধ মন্দির।
এখানে পুরাকীর্তি ছাড়াও চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
৭. পাথর কোট
ধারণা করা হয় এটি একটি সামরিক দুর্গ ছিল।
মাটি ও ইটের তৈরি পুরু দেয়ালের কিছু অংশ এখনো বিদ্যমান।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আশপাশের দর্শনীয় স্থান
রানী ময়নামতির প্রাসাদঃ
ময়নামতি লেক ও পিকনিক স্পট
শালবন বিহার সংলগ্ন এলাকায় ছোট একটি লেক রয়েছে।
পাশে পিকনিক করার জন্য খোলা জায়গা ও বসার ব্যবস্থা রয়েছে।
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা
সুপরিকল্পিত এবং সবুজে ঘেরা এলাকা। এখানেও কিছু পুরাতাত্ত্বিক স্থান রয়েছে।
সেনাবাহিনীর জাদুঘর ও সৌধ দেখতে পারেন (সাধারণত অনুমতি প্রয়োজন হয়)।
ড. আকবর আলী খান পার্ক (সাবেক ধর্মসাগর পার্ক)
এটি কুমিল্লা শহরে অবস্থিত, ময়নামতি থেকে কিছু দূরে।
ছোট লেক, হাঁটার পথ এবং পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর জন্য উপযুক্ত।
প্রাকৃতিক লীলাভূমি হিসেবে ময়নামতি
ময়নামতি শুধুমাত্র প্রত্নতত্ত্বেই নয়, প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যও আদর্শ:
সকাল বেলা কুয়াশাচ্ছন্ন টিলা ও পাখির ডাক প্রকৃতি প্রেমীদের মুগ্ধ করে।
গ্রীষ্মে কাঁঠাল ও লিচুর বাগান, শীতে কুয়াশামাখা বনপথ—প্রতিটি ঋতুর ভিন্ন রূপ দেখা যায়।
সন্ধ্যার সময় পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়, যা আলাদা অভিজ্ঞতা।
ট্রাভেল টিপস ও প্রস্তুতি
কিভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে কুমিল্লা: বাস (তিশা, এশিয়া লাইন, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়া), ট্রেন (উপকূল, মহানগর)
কুমিল্লা শহর থেকে ময়নামতি: অটো, সিএনজি বা মাইক্রোবাসে সহজে যাওয়া যায় (প্রায় ৮–১০ কিমি দূরত্ব)।
সঙ্গে যা রাখা ভালো:
হালকা খাবার ও পানি
ক্যামেরা ও পাওয়ার ব্যাংক
হেঁটে চলার উপযোগী জুতা
ইতিহাসপ্রীতির জন্য একটি ছোট নোটবুক বা গাইডবুক
